বিএনপি চায় রাজপথেই একদফার ফয়সালা

এবার একদফার আন্দোলনে যাচ্ছে ১০ দফার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিএনপি ও এর শরিকরা। ঈদুল আজহার মধ্যে বিএনপি একদফা আন্দোলনের প্রস্তুতি সেরেছে। চলতি জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে এই আন্দোলন মাঠে গড়াতে পারে। ঈদের আগে স্থায়ী কমিটির একাধিক বৈঠক এবং শরিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এই একদফা আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। বর্তমান সরকারের পদত্যাগই মূলত একদফার মূল বিষয়। তবে এর সঙ্গে আরও কয়েকটি দাবি যুক্ত থাকবে। আর দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার চলবে এই আন্দোলন। শোকের মাস আগস্টেও থাকবে কর্মসূচি। তবে সেই কর্মসূচি পালন করা হবে শোক দিবসের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির চূড়ান্ত লক্ষ্য সেপ্টেম্বর-অক্টোবর। মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি ও চাপ কাজে লাগিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই রাজপথে চূড়ান্ত ফয়সালা করতে চায় দলটি। এ লক্ষ্যে চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসনের আচরণ দেখে কর্মসূচি পুনর্বিন্যাস হতে পারে। অবশ্য বাধ্য না হলে সাংঘর্ষিক কোনো কর্মসূচিতে যাবে না বিএনপি।

বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চ সূত্রে জানা গেছে, মধ্য জুলাইয়ে গণআন্দোলনের একদফার যৌথ ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। একই সঙ্গে দেওয়া হবে রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা রূপরেখাও। বিএনপি এবং শরিক দল ও জোটগুলো যার যার প্ল্যাটফর্ম থেকে একই দিনে এই দুটি ঘোষণা একত্রে দিতে পারে। বিএনপি ঢাকায় বড় জমায়েত করে এই ঘোষণা দেবে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে পুরো বিষয় চূড়ান্ত হয়ে যাবে। এই সময়ের মধ্যে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের দুটি এবং গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক হবে।

জানা গেছে, একদফার আন্দোলন হবে ভিন্ন মাত্রার। এই আন্দোলনে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষকেও মাঠে নামাতে চায় বিএনপি। অবশ্য চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রথম ধাপে আবারও জনসম্পৃক্ত ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি আসবে।

দলটির প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, দাবি আদায়ে কয়েক মাস ধরে যে ধরনের কর্মসূচি চলছিল—চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রথম ধাপে আবারও সেগুলোই পালন করা হবে। এর সঙ্গে ঢাকা থেকে বিভাগ অভিমুখে রোডমার্চ, লংমার্চের মতো কর্মসূচি যুক্ত হতে পারে। তবে তা আরও জোরালোভাবে, আরও শোডাউনের মাধ্যমে পালিত হবে। কেন্দ্র ও তৃণমূলে ঘুরেফিরে এই কর্মসূচি পালিত হবে। আর আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ের কর্মসূচি হবে ঢাকামুখী ও ঢাকাকেন্দ্রিক। তবে তখনো বাধ্য না হলে হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস কর্মসূচিতে যেতে চায় না দলটি। এক্ষেত্রে ঢাকামুখী রোডমার্চ, চলো চলো ঢাকা চলো, ঢাকা ঘেরাও, সচিবালয় ঘেরাও, নির্বাচন কমিশন ঘেরাও, গণভবন ঘেরাও, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও, অবস্থান, বড় সমাবেশের মতো কর্মসূচি আসতে পারে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে তাদের ব্যাপক হারে মাঠে নামিয়ে কর্মসূচি সফল করতে চায় বিএনপি।

একদফার আন্দোলন প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা এক বছর ধরে বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছি। এখন তারুণ্যের সমাবেশ হচ্ছে। সামনে পদযাত্রার কর্মসূচি শুরু হবে। আমরা আশা করি, এর মধ্যে আমরা একদফাতে আন্দোলন শুরু করব। একদফার আন্দোলনের ধরন গত আন্দোলনগুলোর চাইতে একটু ভিন্ন হবে এবং জনগণের সম্পৃক্ততাও অনেক বাড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচিতে সচেতনভাবে যাচ্ছি না। তবে সরকার যদি কোনোভাবে সেসব দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে সে দায় সরকারের ওপর বর্তাবে। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনটা করছি, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনেই আমরা চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে চাই।’

বিএনপির সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলন এবং দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ঈদুল আজহাই ছিল সর্বশেষ ঈদ। তাই এই ঈদের মধ্যে আন্দোলনের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও সেরেছে দলটি। কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী বিএনপি নেতারা এবার চূড়ান্ত আন্দোলনের বার্তা নিয়ে নিজ নির্বাচনী এলাকায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদ করেছেন। নেতাদের মধ্যে সাবেক এমপি মফিকুল হাসান তৃপ্তি, কৃষক দলের যুগ্ম সম্পাদক ফজলে হুদা বাবুল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ফিরোজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ঈদ করেন। তারা নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় ও ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান করেছেন। অনেকে আবার মধ্যাহ্নভোজেরও আয়োজন করেন। এসব অনুষ্ঠানে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও অংশগ্রহণ করেছেন। নেতারা তৃণমূলে ওইসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নেতাকর্মী-সমর্থকদের সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের নির্দেশনা ও প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা দেন। বিএনপির দাবি, ঈদুল আজহায় কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে পেয়ে নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত, যা ভবিষ্যৎ আন্দোলন সফলে সহায়ক হবে।

গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে ১০ দফার ভিত্তিতে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। ১৪ দফা নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১০ দফা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী, ১৩ দফা নিয়ে গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, ৭ দফা নিয়ে গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি) ওই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। এর বাইরে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটও যুক্ত হয় আন্দোলনে। এদিকে এলডিপি শুরু থেকেই এককভাবে যুগপতের কর্মসূচি পালন করছে। আর গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে বেরিয়ে গণঅধিকার পরিষদ এবং ১২ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া লেবার পার্টি পরবর্তী সময় পৃথকভাবে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। সর্বশেষ সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ১২ দলীয় জোট থেকে এনডিপিকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও দলটি যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকবে। সব মিলিয়ে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে ৩৯টি দল সম্পৃক্ত রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ এবং জাগপা—এ দুটি দলের দুই অংশ দুটি জোটে রয়েছে।

এদিকে আন্দোলন শুরুর একপর্যায়ে যুগপতের ভিত্তি হিসেবে একটি ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের মধ্যে মতপার্থক্যের কারণে ঘোষণাপত্র এখনো চূড়ান্ত করা যায়নি। তবে অভিন্ন একদফা ঘোষণার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছান তারা। এমন প্রেক্ষাপটে ঈদুল আজহার আগে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বৈঠক হয়। সেখানে একদফা ঘোষণা এবং আন্দোলনের কর্মসূচির ধরন নিয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া ওই বৈঠকে রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা ঘোষণার ব্যাপারেও একমত হন নেতারা। আগামী ৫ জুলাই বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের পরবর্তী বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে।

সূত্রমতে, একদফা যৌথ ঘোষণায় থাকছে—বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও বর্তমান সংসদের বিলুপ্তি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করে তার অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি, মিথ্যা-গায়েবি মামলা প্রত্যাহার, ফরমায়েশি সাজা বাতিল, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।

জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, দুটি ঘোষণাই (আন্দোলনের অভিন্ন একদফা এবং রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা) একত্রে দেওয়া হতে পারে। একই দিনে শরিকরা যার যার মতো করে এই ঘোষণা দিতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপির চার সংগঠনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে আগস্টে পদযাত্রার কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। তাই আগস্টে যুগপতেরও কিছু কর্মসূচি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে শোক দিবসের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখেই সেই কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে।

রাষ্ট্র মেরামতের ‘যৌথ রূপরেখা’ প্রায় চূড়ান্ত জানিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শরিক দল গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি এবং ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, আমরা ৩১ দফার একটা রূপরেখা ঠিক করছি। সেখানে কিছু কিছু পয়েন্টে এখনো একটু মতপার্থক্য আছে, সেটা নিরসনের চেষ্টা চলছে। তবে নিরসন যদি পুরোপুরি নাও হয়, যতটুকু আমরা ঐকমত্য হতে পারব তার ভিত্তিতেই রূপরেখা দেওয়া হবে।

ঈদুল ফিতরের পর থেকে বিএনপি এককভাবে কর্মসূচি করছে। আর বিএনপির কর্মসূচির মধ্যেই ঢাকাসহ দেশের ছয়টি বড় শহরে ১১ দফার ভিত্তিতে ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ করছে দলটির প্রধান তিন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। ১৪ জুন চট্টগ্রামে কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তারুণ্যের এ সমাবেশ শুরু হয়েছে। ২২ জুলাই ঢাকায় সমাবেশের মধ্য দিয়ে তা শেষ হবে। এ ছাড়া বিএনপির অন্য চার অঙ্গসহযোগী সংগঠন কৃষক দল, শ্রমিক দল, তাঁতী দল ও মৎস্যজীবী দলের যৌথ উদ্যোগে ‘দেশ বাঁচাতে মেহনতি মানুষের পদযাত্রা’ শীর্ষক কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে। ১৫ জুলাই থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত ছয় বড় জেলায় এ পদযাত্রা হবে। এদিকে বিএনপির পাশাপাশি যুগপতের শরিক দল ও জোটগুলোও কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে রয়েছে। যুগপতের ধারায় দলীয় ব্যানারে কর্মসূচি পালন করছে তারা। গত ৪ থেকে ৬ জুন পর্যন্ত ঢাকা থেকে দিনাজপুর অভিমুখে রোডমার্চ করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। এ ছাড়া ১৯ থেকে ২১ জুলাই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ কর্মসূচি রয়েছে ছয় দলীয় এই জোটের।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।