আমেরিকা-ইসরায়েলের বন্ধুত্ব কি শেষের পথে?

বহুকাল ধরেই মার্কিন-ইসরায়েলের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে আসছে। কিন্তু গত কয়েক মাসে এ সম্পর্কের যে পরিবর্তন ঘটেছে তাতে আশ্চর্য হতে হয়।

ইসরায়েলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত টম নিডসের শুক্রবারের টুইটটি উদাহরণ হিসেবে আমলে নেওয়া যেতে পারে। টুইটে ইসরায়েল-লেবানিজ সীমান্তে নিজের এবং ইসরায়েলি সৈন্যদের একটি ভিডিও রয়েছে, যেখানে তিনি সবাইকে ‘শাব্বাত শালোম’ শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এমন এক সময়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রতি সমর্থনের এই উদ্ভট প্রদর্শন হলো যখন লেবাননের সঙ্গে ইসরায়েল যুদ্ধে লিপ্ত এবং দুই দেশের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে।

জুনের শুরুতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট হুমকি দিয়েছিলেন যে, লেবাননের হিজবুল্লাহ যুদ্ধ শুরু করলে বোমা মেরে তাদের আবার ‘প্রস্তর যুগে’ পাঠিয়ে দেওয়া হবে। একইভাবে, ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান আমির বারাম ঘোষণা করেছেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দক্ষিণ লেবাননে ‘সব অবকাঠামোর … শেষ পাথর পর্যন্ত ধ্বংস করবে’ – যা যুদ্ধাপরাধের শামিল।

টুইটারে “শাব্বাত শালোম” ক্লিপটি প্রকাশের তিন দিন পর সোমবার ইসরায়েলের সাঁজোয়া যান, হেলিকপ্টার এবং ড্রোনসহ এলিট বাহিনীর ১০০০ সৈন্য অধিকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন শরণার্থী শিবিরে তথাকথিত অভিযানের জন্য পাঠানো হয়েছে। তারা সেখানে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নারী, শিশুসহ অন্তত আটজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।

ফিলিস্তিনিদের ওপর মারাত্মক হামলা চালানো ছাড়াও, ইসরায়েলি কর্মকর্তারা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সমর্থনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক অবস্থানকে বারবার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। গত সপ্তাহে, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু নেসেটের পররাষ্ট্র নীতি কমিটিকে বলেছিলেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা “নির্মূল” করতে হবে।

ইসরায়েলি নেতা চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ প্রকাশ্যের জন্য উষ্মা প্রকাশ করেছেন। অতি সম্প্রতি তিনি ঘোষণা করেছেন দ্রুতই বেইজিং ভ্রমণ করবেন। এর মাধ্যমে তিনি মার্কিন প্রশাসনকে একটি বার্তা দিতে চান। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এখনো তাকে ওয়াশিংটন সফরের আমন্ত্রণ জানায়নি।

নেতানিয়াহু এবং তার মন্ত্রিপরিষদ ক্রমাগতভাবে বাইডেন প্রশাসনের নীতির সমালোচনা করে যাচ্ছে। মার্চ মাসেই নেতানিয়াহু আমেরিকার এক নেতাকে ইসরায়েলের বিতর্কিত বিচারিক সংস্কার সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য ব্যাপক সমালোচনা করেছিলেন। বিচারিক এ সংস্কারের জন্য ইসরায়েলজুড়ে মাসব্যাপী বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলের প্রবাসীবিষয়ক মন্ত্রী আমিচাই চিকলি ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে “হস্তক্ষেপ” করার জন্য নিডসকে তিরস্কার করেছিলেন এবং তাকে তার ব্যবসার কথা মনে রাখতে বলেছিলেন।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতই একমাত্র মার্কিন কর্মকর্তা নন যিনি ইসরায়েলি সরকারের ক্রমবর্ধমান অবজ্ঞার মধ্যে উদ্ভট কূটনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত হলেন।

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপন এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা সত্ত্বেও ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র লবিং করেছিল। কিন্তু ইসরায়েলের সাম্প্রতিক কথাবার্তা ও কাজকর্মে বাইডেন প্রশাসন বিব্রত।

তারপরও মার্কিন কংগ্রেস ঘোষণা করেছে যে, ইসরায়েলি রাষ্ট্রপতি আইজ্যাক হারজোগ ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বার্ষিকীতে উভয় হাউসে ভাষণ দেবেন, এর আগে নেতানিয়াহু তিনবার এ সুযোগ পেয়েছিলেন।

শেষবার নেতানিয়াহু কংগ্রেসের একটি যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছিলেন ২০১৫ সালে। ইরানের সঙ্গে একটি পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষর বিষয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনের সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। ২০১১ সালে হোয়াইট হাউসে ফিলিস্তিন এবং মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে ওবামার বক্তৃতা প্রদানের পরও তিনি প্রকাশ্যে উষ্মা প্রকাশ করেন।

ওবামা প্রশাসন ১০ বছরে ইসরায়েলকে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা পাঠাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। এমনকি ইসরায়েলের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার জন্য ভর্তুকি দেওয়া হয়। এটি ছিল “মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি”, আমেরিকান করদাতার একটি মূল্যবান উপহার। এতেও ইসরায়েলের মন গলেনি।

গত বছর, বাইডেন প্রশাসন একটি নতুন কৌশলগত স্মারক সই ও জেরুজালেম ইউএস-ইসরায়েল যৌথ অংশীদারিত্ব ঘোষণায় সামরিক প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণে নতুন করে অঙ্গীকার করেছেন।

এমন অবস্থায় ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে কয়েকটি দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

প্রথমত, মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অবস্থা। বাইডেন প্রশাসন ও সিনেটে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও ইসরায়েলকে রাগাতে চাইছে না। কারণ রিপাবলিকানরা এখনো প্রতিনিধি পরিষদকে নিয়ন্ত্রণ করছে, যারা নেতানিয়াহুকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে। সম্ভবত এ কারণেই বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পরাশক্তি দেশের নেতা বাইডেন ইসরায়েলকে ইউনেস্কোতে পুনরায় যুক্ত করতে অনুমোদন দিয়েছেন।

দ্বিতীয় বিষয় হলো ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক কৌশল। বাইডেন “ইসরায়েলের প্রতি ভালোবাসা” প্রকাশের জন্য নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন। একটি ঔপনিবেশিক, বর্ণবাদী শাসনের প্রতি এ ধরনের ভুল পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি ওয়াশিংটনে একটি আবেশে পরিণত হয়েছে, যা দেশের বাকি অংশ থেকে, প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

প্রকৃতপক্ষে, যখন ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের প্রসঙ্গ আসে, তখন বাইডেন এবং অনেক ডেমোক্র্যাট সিনেটর ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। এতে দলের ইহুদি সদস্যদের মধ্যেও অসন্তোষ বাড়ছে।

২০১৩ সালের গ্যালাপ জরিপ অনুসারে, ৪৯ শতাংশ ডেমোক্র্যাট ফিলিস্তিনিদের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল, ৩৮ শতাংশ ইসরায়েলিদের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল এবং ১৩ শতাংশ কোনোটির প্রতিই সহানুভূতিশীল নয়।

তৃতীয়ত, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি। ওয়াশিংটনের প্রচলিত প্রজ্ঞা দীর্ঘকাল ধরে ইসরায়েলের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষাকে সন্তুষ্ট করে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার বিষয়ে তার অবস্থানকে সংযত করতে এবং শান্তির জন্য প্রয়োজনীয় “সমঝোতা”, এমনকি “ত্যাগে উৎসাহিত করার জন্য আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে, নিঃশর্ত মার্কিন সমর্থন এ পর্যন্ত ইসরায়েলের অবস্থানকে কঠোর করেছে, দেশটির সমাজকে উগ্রবাদী করেছে এবং রাজনীতিকে ফ্যাসিবাদের দিকে ধাবিত করেছে।

সর্বশেষ বিষয় হলো, ওয়াশিংটনের কৌশলগত চিন্তাভাবনাও রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে শক্তিশালী এবং ধারাবাহিক কৌশলগত সহযোগিতা বজায় রেখেছে। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উত্থান-পতন সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে দেখেছে। ঠিক গত বছর, বাইডেন এই মন্ত্রটি পুনরাবৃত্তি করে বলেছিলেন যে, ইসরায়েল না থাকলে “আমাদের আরেকটি ইসরায়েল আবিষ্কার করতে হবে।” কিন্তু একে কৌশলগত সম্পদ হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে বিবেচনা করার উপযোগিতা হারিয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধ শেষের পর থেকে ইহুদিবাদী এ রাষ্ট্রটি যুক্তরাষ্ট্রের দায় হিসেবে নিজেকে হাজির করেছে।

প্রকৃতপক্ষে, ইসরায়েলের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো আমেরিকাকে মধ্যপ্রাচ্যে আটকে রাখা। নেতানিয়াহু তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বেশ সৎ ছিলেন, তিনি নেসেট সদস্যদের বলেছিলেন যে, এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা খারাপ নাও হতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্র চাপে থাকবে এবং ইসরায়েলের পক্ষে আরও সুবিধা আদায় করা সহজ হবে।

তবে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ও নীতি বেশিরভাগ দেশ ভালোভাবে গ্রহণ করছে না। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ বাড়ছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখছে। ইসরায়েলের বিভ্রান্তিকর প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করে ওয়াশিংটন এই অঞ্চলে একজন দায়িত্বশীল এবং সম্মানজনক অভিনেতা হিসেবে কাজ শুরু করতে পারে।

ফিলিস্তিনের ন্যায়বিচারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অবস্থা পরিবর্তন হলে কিছুটা আশার সঞ্চার করবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।