নিজেদের কিডনি বেচে তারা এখন কিডনি বেচা-কেনার চক্রে

এক যুগ আগে জয়পুরহাটে কিডনি বেচা-কেনার চক্রের সন্ধানে তোলপাড় উঠেছিল প্রশাসনে। পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন অনেকে, মামলাও হয়েছিল বেশ কয়েকটি।

সেই ঘটনা প্রায় চাপা পড়ে গেলেও বেআইনিভাবে অঙ্গ বিক্রি থেমে নেই। জয়পুরহাটের কাছের জেলা নাটোরের গুরুদাসপুরে দাঁড়িয়ে গেছে তেমন একটি চক্র। দরিদ্র মানুষের ঋণ আর অভাবকে পুঁজি করে সেখানে চলছে ‘কিডনি বাণিজ্য’। সেখানে কেউ কেউ অভাবের তাড়নায় কিডনি বিক্রি করে এখন নিজেরাই অবৈধ এই অঙ্গ-বাণিজ্যের জাল বিস্তারে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।     

কিডনি বিক্রেতা, কিডনি গ্রহীতা, মধ্যস্থতাকারী এবং তাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গুরুদাসপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রাম থেকে এক দশকে অন্তত ৫০ জন মানুষ তাদের একটি করে কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন। অভাবি মানুষেরা অর্থের লোভে নিজেরাই দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের কিডনি বিক্রির প্রস্তাব দিচ্ছেন। 

দালাল খুব গোপনে প্রথমে কিডনি দাতাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এখানে দাতার প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, দাতা ও গ্রহীতার রক্ত সম্পর্কের কাগজপত্র তৈরি করা হয়। পরে তাদের ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই কিডনি প্রতিস্থাপনের মূল কাজটি হয় বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। কারণ দেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইনে এভাবে কিডনি দেওয়া যায় না।

গুরুদাসপুরের গাড়িষাপাড়া, আনন্দনগর, শিকারপুর-সাহাপুর, নাজিরপুর, চাঁচকৈড় বাজার, মধ্যমপাড়া, বামনকোলা, জুমাইনগর, খলিফাপাড়ায় অনুসন্ধান চালিয়ে গত এক মাসে পাঁচজন দাতা, দুজন গ্রহীতা এবং কিডনি দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন এমন একজনসহ ৯-১০ জনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। এই চক্রের ভেতরকার খবর পেতে কিডনি দাতা পরিচয় দিয়ে চলে এই অনুসন্ধান।

একজন গ্রহীতা জানিয়েছেন, তিন বছর আগে কিডনি প্রতিস্থাপনের সব কাজ শেষ করতে তার মোট ৪৪ লাখ টাকার মত খরচ হয়েছে। আর গুরুদাসপুরের যে ব্যক্তি এই কিডনি দান করেছেন তিনি জানিয়েছেন, এ বাবদ তিনি মাত্র চার-সাড়ে চার লাখ টাকা পেয়েছেন। বাকি টাকা দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে গেছে।

কিডনি দানের পর এখন আর দাতারা ভারী কোনো কাজ করতে পারেন না; যদিও সবাই নিজেদের সুস্থ বলে দাবি করেছেন। তবে যে অভাবের কারণে তারা কিডনি বিক্রি করেছিলেন, টাকা পেয়ে সেই অভাব হয়ত সাময়িকভাবে তাদের গিয়েছিল। কিন্তু অনেকেই আবার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। কয়েকজনকে পাওয়া গেছে, যারা এখন স্ত্রীর কিডনি বিক্রির চেষ্টা চালাচ্ছেন ঋণ থেকে মুক্তির আশায়।

তবে গুরুদাসপুরের চার থেকে পাঁচটি চক্রের কেউ, ঢাকায় কারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে রাজি হয়নি। দেশের বাইরে কারা এই চক্র নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের বিষয়েও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-১৯৯৯’ এ উল্লেখ আছে, ‘নিকটাত্মীয়’ অর্থাৎ পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, ভাই, বোন ও রক্ত সম্পর্কিত আপন চাচা, ফুপু, মামা, খালা ও স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য কারও শরীরের অঙ্গ নেওয়া যাবে না।

আইনে বলা আছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় বা উপহারের বিনিময়ে কোনো প্রকার সুবিধা লাভ এবং সেই উদ্দেশ্যে কোনোপ্রকার বিজ্ঞাপন প্রদান বা অন্য কোনোভাবে প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারা বিশ্বেই উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে কিডনিজনিত সমস্যা। আর বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার মানুষ কিডনি বিকলের শিকার হন।

চিকিৎসকরা জানান, চাহিদার তুলনায় দাতা কম বলে কিডনির বাজারমূল্যও উচ্চ। কিডনি রোগীদের বেঁচে থাকতে হয় ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে; যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিডনি প্রতিস্থাপন অনেক ব্যয়বহুল ও জটিল।

ঋণগ্রস্ত আর অভাবিরাই লক্ষ্য

স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে সুখী পরিবার ছিল উপজেলার আনন্দনগরের বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম আরিফের। মাঠে জমি ছিল, বাজারে ছিল দোকান। হঠাৎ করেই তার দুটো কিডনি অকেজো হয়ে যায়। রাজশাহী গিয়ে সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হত অন্তত ১০ হাজার টাকা। চিকিৎসার খরচ জোগাতে জমি, দোকান, স্ত্রীর গহনা, সবশেষ বসতভিটাও বিক্রি করে দেন। বড় বোন কিডনি দিতে চেয়েছিলেন, ম্যাচও করেছিল; কিন্তু বয়স বেশি হওয়ায় দিতে পারেননি।  

আরিফের বড় ভাই চাঁচকৈড় বাজারের কাপড় বিক্রেতা জাহিদুল ইসলাম জাহিদ এসব তথ্য যখন দিচ্ছিলেন তখন তার সজল চোখ; বলেছিলেন, “বড় আপা চেষ্টা করেও ভাইটাকে বাঁচাতে পারেনি।

“অন্যজনের কিডনি নেওয়ার আইন তো বাংলাদেশে নাই। আর কিডনি ব্যবসায়ীদের কাছে কিডনি নিয়ে ধরা পড়লে জেল-জরিমানার ভয়ে সে পথে আগাইনি আমরা। তারপর তো ভাই চলে গেল।”

আরিফুল ইসলাম আরিফ ‘রক্ত-সম্পর্কের’ বাইরে গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করাতে না পারলেও অন্যের কিডনি নিয়ে জীবন বাঁচাতে পেরেছেন উপজেলার নাজিরপুরের বেড়গঙ্গারামপুরের চল্লিশোর্ধ্ব মোকসেদ মিয়া (ছদ্মনাম)। তাকে কিডনি দিয়েছেন নাজিরপুর সামাদের মোড় এলাকার ভ্যান-রিকশা মেকানিক মো. কাসেম (ছদ্মনাম)। মোকসেদ মিয়ার সঙ্গে মো.কাসেমের রক্ত সম্পর্কের কোনো আত্মীয়তা নেই।

কাসেম স্বীকার করলেও মোকসেদ মিয়া তার কাছ থেকে কিডনি নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, তিনি এক আত্মীয়ের কাছ থেকে কিডনি নিয়েছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।