ঈদকে সামনে রেখে সড়ক-মহাসড়কে ডাকাতচক্র সক্রিয়

নাছির উদ্দিন শোয়েব: কুরবানির ঈদকে সামনে রেখে সক্রিয় হয়ে ওঠছে আন্তঃজেলা ডাকাতচক্রের সদসরা। মহাসড়কে বিভিন্ন যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাক এবং প্রাইভেট পরিবহণ প্রায়ই ডাকাতের কবলে পড়ে। তবে কুরবানির ঈদকে সামনে রেখে আন্তঃজেলা ডাকাত চক্রের সদস্যরা বেশি সক্রিয় হয়। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চলাচল করা পশুবাহি ট্রাককে টার্গেট থাকে ওদের। পশুর ট্রাক, গরু ব্যবসায়ী, দূরপাল্লার বাসের যাত্রীদের টার্গেট করে এসময় ডাকাতচক্র দাপিয়ে বেড়ায় বলে অভিযোগ আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, মহাসড়কে অন্তত ২৫ ডাকাতচক্র সক্রিয় আছে। র‌্যাব-পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন সময় এ চক্রের কিছু সদস্য গ্রেফতারও হচ্ছে। কিন্তু মূল হোতাসহ অন্য সদস্যরা এখনো অধরা। তবে তাদের তালিকা হাইওয়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রয়েছে বলে জানা যায়। 

অভিযোগ, ডাকাতির ঘটনায় মামলা করতে গিয়ে হয়রানির ভয়ে অনেক ভুক্তভোগী থানায় যান না। এতে আড়ালেই থেকে যায় অনেক ঘটনা। এছাড়া মহাসড়কের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধেও ব্যর্থতার অভিযোগ ওঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ডাকাতদের উৎপাত ঠেকাতে গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। ঈদুল আজহাকে ঘিরে সড়ক-মহাসড়কে কোনোরকম বিশৃঙ্খলা যেন না হয়। গরু নিয়ে ব্যবসায়ীরা নির্বিঘেœ যেন চলাচল করতে পারে সে জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দারা। বেশ কিছু দিন ধরে ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানার কবিরপুর এলাকায় একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র দেশীয় অস্ত্র দেখিয়ে পথচারী, রিকশাচালকসহ যাত্রীদের জিম্মি করে তাদের সর্বস্ব লুট করে নিচ্ছিল এবং ক্ষেত্র বিশেষে হত্যার উদ্দেশ্যে যাত্রীদের ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যাচ্ছিল। এ ঘটনায় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্থানীয় জনতা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করে। এতে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ডাকাত ও আন্তজেলা ডাকাতি ও ছিনতাইকারী দলের মূলহোতা মো. আলী ওরফে আলী ডাকাত তার দলবল নিয়ে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানার নবীনগর এলাকায় কয়েকজন সন্ত্রাসী সংঘবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন সময় ডাকাতি করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ও আন্তজেলা ডাকাতি চক্রের সরদার মো. আলী হোসেন আলীসহ ১০ জন ডাকাতকে গ্রেফতার করা হয়। সম্প্রতি টাঙ্গাইলের মধুপুরে যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ডাকাতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন অন্তত সাত জন। 

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় মহাসড়কে ডাকাতিতে ২৫টির বেশি ডাকাত গ্রুপ জড়িত। এরমধ্যে ঢাকা ও আশপাশের মহাসড়কে ১২টির বেশি গ্রুপ সক্রিয়। মহাসড়কের ডাকাত গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- দিলীপ ওরফে সোহেল গ্রুপ, আবু জাফর গ্রুপ, মনু গ্রুপ, সাতক্ষীরা বিপ্লব গ্রুপ, বরিশাইল্যা বিল্লাল গ্রুপ, কুমিল্লা গ্রুপ, ময়মনসিংহ গ্রুপ, হুমায়ুন গ্রুপ, হীরা গ্রুপ, চিটাগাইংগ্যা নুরু গ্রুপ, রহিম গ্রুপ, শহিদ গ্রুপ, সিদ্দিক গ্রুপ, জহির গ্রুপ, ইসমাইল গ্রুপ, আজম গ্রুপ, হাবিব গ্রুপ, মোখছেদ গ্রুপ ও সরোয়ার গ্রুপ। প্রতিটি গ্রুপে ১২ থেকে ২০ জন ডাকাত রয়েছে। একেকটি গ্রুপে শতাধিক অস্ত্রধারী সদস্য রয়েছে। তাদের কাছে পিস্তল, রিভলভার ও চাইনিজ কুড়ালের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের দেশি অস্ত্রও থাকে। ডাকাতি করতে গিয়ে কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তাকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করে অন্যরা। 

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির এক নেতা বলেন, নাইট কোচে যাত্রীদের ভিডিও ধারণ, কাউন্টার ছাড়া যাত্রী না তোলা এবং যাত্রাপথে রেস্তোরাঁয় বিরতির পর আবার ভিডিও করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, মহাসড়ক ছাড়া কোনো বাইপাস সড়ক বা স্থানীয় সড়ক ব্যবহার না করতে পরিবহণ চালক-শ্রমিকদের নির্দেশ দেওয়া আছে। একটি পরিবহনের মালিক বলেন, ডাকাতদের কবল থেকে যাত্রীদের সুরক্ষিত থাকতে তারা রাতের এসি গাড়িগুলোতে যাত্রীদের ছবি তুলে রাখেন। আর নন-এসি গাড়িগুলোতে চালকদের পাশে গ্রিল দেওয়া হয়েছে। রাতে গ্রিল লক করে রাখা হয়। তিনি আরও বলেন, কোনো ডাকাত যাত্রীবেশে উঠলেও চালককে যাতে জিম্মি করে বাসের নিয়ন্ত্রণ না নিতে পারে সেজন্য এ ব্যবস্থা। তিনি বলেন, এ পদ্ধতি অবলম্বন করে তারা বেশ ভালো ফল পেয়েছেন। তিনি বলেন-চালক, শ্রমিক ও যাত্রীদের সুরক্ষিত রাখতে এ ধরনের কৌশল সব পরিবহণের করা উচিত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ৩০-৩৫টি জায়গায় প্রায়ই ডাকাতি হচ্ছে। এর মধ্যে আছে কাঁচপুর, আশুলিয়া, এলেঙ্গা, চম্পাগঞ্জ, মির্জাপুর, কালিয়াকৈর, কবিরপুর, বাইপাইল, নবীনগর, সাভার, হেমায়েতপুর, গেন্ডা, চন্দ্রা, কোনাবাড়ী, ধামরাই, কামালপুর, মানিকগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ ও রূপগঞ্জ। কোনো কোনো সড়কে যানজট দেখা দিলে তখন গণছিনতাই ও গণডাকাতির ঘটনা ঘটে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় সড়ক-মহাসড়কে ঘুরেফিরে ডাকাতি করে- এমন পেশাদার ৪০ জনের নাম-পরিচয় পেয়েছে পুলিশ। কর্মকর্তারা জানান, ডাকাত ও ছিনতাই চক্রের সদস্যদের প্রধান টার্গেট হলো পণ্যবাহী গাড়ি। এ ছাড়া যাত্রীবাহী বাস, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকরাও তাদের শিকার। কিছু কিছু সড়কে ঢিল ও ডিম পার্টিও সক্রিয়। গাড়িতে ঢিল ছুড়ে ও ডিম মারার পর চালক যখন সেটি থামান, তখন সহযোগীদের নিয়ে যাত্রীদের সব কিছু কেড়ে নেওয়া হয়। 

কিছু দিন আগে আন্তঃজেলা ডাকাত দলের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিএমপি, ডিবি) গুলশান বিভাগের ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিম। এ সময়ে তাদের কাছ থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র ও তিনটি মোবাইল জব্দ করা হয়। সাভারের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- ফখরুল কবির শান্ত, মো. মনির হোসেন, মো. ইমরান, মো. মুজাহিদ ওরফে বাবু, মো. রাজিব ওরফে আসিফ এবং মো. সানি। এ ঘটনায় সাংবাদিক সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১২টার দিকে আট থেকে ১০ জনের একটি ডাকাত দল গাড়ির ভিতরে ঢুকে ওই জায়গায় কেন গাড়ি পার্কিং করেছে তার কারণ জানতে চায়। ডাকাতদের কথাবার্তায় বাসের ড্রাইভার হেলপার ও সুপারভাইজার বশ্যতা স্বীকার করলে ডাকাত দলের নেতা গ্রেপ্তারকৃত শান্তর নেতৃত্বে তার সহযোগী গ্রেপ্তারকৃত সুমন, মনির বাসের চালক, চালকের সহকারী ও সুপারভাইজারের কাছে মানিব্যাগ-মোবাইল ফোন চান। এতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের রড হুইলরেঞ্জ ও পাইপ দিয়ে মারধর করে মোবাইল ফোন ও টাকা ছিনিয়ে নিয়ে চালক, চালকের সহকারী সুপারভাইজারের চোখ ও হাত কাপড় দিয়ে বেঁধে পিছনের সিটে ফেলে রাখে। অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ডাকাতদের দলনেতা গ্রেপ্তারকৃত শান্ত গাড়ি চালিয়ে কিছুদূর এসে ডাকাত দলের অন্য সদস্য ইমরানকে গাড়ি চালাতে বলে। পরবর্তিতে ডাকাত দলের কয়েকজন নিজেরাই যাত্রী, চালকের সহকারী সুপারভাইজার সেজে গাবতলী-আসাদগেট-নিউমার্কেট-আজিমপুর-যাত্রাবাড়ী-কাচপুর হয়ে একই পথে এসে আমিনবাজার-সাভার-চন্দ্রার বিভিন্ন জায়গা থেকে একজন একজন করে যাত্রী তুলে মারধর করে তাদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়। পরবর্তীতে তাদের চোখ ও পিঠমোড়া করে হাত বেঁধে বাসের পিছনে ফেলে রাখে। ডাকাতদল সারারাত ডাকাতি করে ভোর সাড়ে ছয়টা থেকে সাতটার দিকে আহত যাত্রীসহ বাসটি সাভারের কবিরপুরে রাস্তার পাশে ফেলে চলে যায়। 

কঠোর অবস্থানে হাইওয়ে পুলিশ: হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা অঞ্চলের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেছেন, কুরবানির ঈদকে সামনে রেখে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চাঁদাবাজি ঠেকাতে পুলিশ কঠোর অবস্থানে থাকবে। তিনি বলেন, কোনোভাবেই পশুবাহী যানবাহনে চাঁদাবাজি করতে দেওয়া হবে না। প্রয়োজনে পশুবাহী যান গন্তব্যে পৌঁছে দেবেন হাইওয়ে পুলিশের সদস্যরা। রোববার হাইওয়ে পুলিশ কুমিল্লা অঞ্চলের মাসিক কল্যাণ ও হাইওয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সভা শেষে পুলিশ সুপার এসব কথা বলেন। তিনি নিজেই একটি স্পেশাল টিমসহ মহাসড়কের শৃঙ্খলা তদারকি করবেন জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, হাইওয়ে পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি বিশেষ ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় হাইওয়ে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ১০০ প্রশিক্ষিত সদস্য দায়িত্বে থাকবেন। দুর্ঘটনা বা প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পাঁচটি সরকারি ও ১২টি বেসরকারি রেকার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি যে কোনো দুর্ঘটনা সামাল দিতে পর্যাপ্তসংখ্যক অ্যাম্বুলেন্সও প্রস্তুত থাকেবে। রহমত উল্লাহ বলেন, “কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ কুমিল্লা অঞ্চলের আওতাধীন ৮২১ কিলোমিটার জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে কোথাও কোনো সংগঠন বা কোনো চক্রকে চাঁদাবাজি করতে দেওয়া হবে না। এ ছাড়া নির্দিষ্ট গন্তব্য ছাড়া অন্য কোথাও জোর করে গাড়ি থেকে কুরবানির পশু নামাতে দেওয়া হবে না। যেখানেই অনিয়মের খবর আসবে সেখানেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অভিযোগ ছাড়া পশুবাহী গাড়ি থামানো নয়:  এদিকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া পশুবাহী গাড়ি না থামানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। একইসঙ্গে কুরবানির পশু পরিবহণে কেউ বাধা সৃষ্টি করলে নিকটস্থ থানা অথবা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করার জন্য অনুরোধ করেন তিনি। সোমবার বিকেলে পুলিশ সদর দপ্তরের হল অব প্রাইডে এক সভায় আইজিপি এ নির্দেশনা দেন। পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা, সড়ক, রেলপথ ও নৌপথের নিরাপত্তা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে এই সভার আয়োজন করা হয়। সভায় চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, কুরবানির পশুবাহী গাড়ি কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া থামানো যাবে না। যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা বজায় রাখার লক্ষ্যে হাইওয়েতে ফিটনেসবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলাচল করতে পারবে না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।