ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন….আমি মূল্যস্ফীতি বলছি

যদি না তাৎক্ষণিক আমদানি (বৈধ অথবা অবৈধ) এবং অতীত বিনিয়োগ থেকে এখন উৎপাদন বৃদ্ধিতে কিউ বেড়ে যায়। অর্থাৎ সিন্ডিকেশনে কিউ-এর অংশবিশেষ দৈনন্দিন বাজারের জোগানটি আটকে দিলেই আমার মাত্রা আকাশচুম্বী হয় এবং সিন্ডিকেটধারীরা উইন্ডফল প্রফিট মাধ্যমে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান।

বাংলাদেশের শুরুতে আমার হালচাল : কয়েক শতাব্দী ধরে পশ্চাৎভূমি হিসেবে লুণ্ঠিত-বঞ্চিত পূর্ববাংলা থেকে ১৯০ বছরে ব্রিটিশ রাজের উপনিবেশ আর অসভ্য পাকিস্তানি আধা-উপনিবেশ শাসনে অঢেল ধনসম্পদ লুটপাট হয়ে যায়। শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু; ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা) নামে শানে আদর্শে এবং অকুতোভয় সংগ্রামী পথে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধে এক মহাসাগর রক্ত পেরিয়ে পূর্ববাংলার বীর জনগণ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অখণ্ড পূর্ববাংলার প্রথম স্বাধীন দেশ হিসেবে নতুন দিবাকর ছিনিয়ে আনে। ১৯৭০-৭১-এর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামকালে কিষান-কিষানি লাঙল চকম ছেড়ে জয় বাংলার অন্বেষণে যোগ দেন। শ্রমজীবীরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা অনুসারে ১৯৭১-৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সমন্বিত জাতীয় আয় জিডিপি ১১ শতাংশ কমে ৮৫০ কোটি মার্কিন ডলারে নেমে আসে। মাথাপিছু আয় ১০০ ডলারেরও কম। শিক্ষার শতকরা হার ২৩ ভাগ, গড় আয়ু ৪৩ বছর, শিশুমৃত্যু হাজারে ২০০। রিজার্ভ ১৮ ডলার। গুদামে খাদ্য নেই। মাঠে ফসল নেই। কলকারখানায় চাক্কাজাম। জনসন-কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ি, হিউস্ট ফাল্যান্ড-পার্কিনসনের অর্থনৈতিকভাবে না টেকার অশনিসংকেত তথা টেস্ট কেস ও অন্যদের অপমানসূচক লাথি-গুঁতাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্বে বীরের জাতি ঘুরে দাঁড়ায়। সারা বিশ্বকে আমি সত্তর দশকের শুরুতে টালমাটাল করে দিই—খরায় শস্যহানি, মধ্যপ্রাচ্যে অর্থনৈতিক পেশি প্রদর্শনে অপরিশোধিত জ্বালানির দাম আমি ১৯৭৩ সালে ব্যারেলপ্রতি ৪ ডলার থেকে ১২ ডলারে উঠিয়ে ফেলি, চারদিকে নিত্যপণ্যের জন্য হাহাকার আর আকাশছোঁয়া দাম। রিজার্ভের ১৮ ডলারের সঙ্গে কানাডা ও সুইডেনের খাদ্য ও পণ্য সাহায্য ছাড়াও কিছু নগদ বৈদেশিক মুদ্রা যোগ হয়ে ভারত থেকে ৫০ কোটি ডলার বন্ধুপ্রতিম ঋণ সাহায্য পাওয়া যায়— আইএমএফের সদস্যভুক্তি এবং জাতির পিতার অসাধারণ দূরদর্শিতার ফলে বিশ্বব্যাংকসহ বাজার অর্থনীতিতে সংযুক্ত হয়ে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের নিজস্ব ধারার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। প্রায় বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ সার, বীজ, কীটনাশক ও কৃষিঋণ পেয়ে যান বঙ্গবন্ধুর সুহৃদরা— কিষান-কিষানি। যুক্তরাষ্ট্রের পিএল ৪৮০ থেকে প্রাপ্ত কাউন্টার পার্ট ফান্ড দিয়ে মুরগি পালনে বিপ্লব এবং পল্লী বিদ্যুতায়নে শিল্প-কলকারখানায় প্রাণ সঞ্চার হয়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হয় বাজেটের যথাক্রমে ২০.৪ ও ১৮ ভাগ। কৃষিপণ্যসহ সব খাতে বঙ্গবন্ধুর উপহার আসে অর্থনীতির বিপুল পুনরুত্থানে। ১৯৭৪-৭৫ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘটে ৭.৮ শতাংশ। আমি ১৯৭০-৭১ সালে শতকরা ৬২ ভাগের তুলনায় ১৯৭৪-৭৫ সালে নেমে আসি শতকরা ৪২ ভাগে।

প্রদানকারীদের প্রণোদনা দেওয়ার নামে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রতি ডলারে ২.৫০ টাকা কুক্ষিগত করার সুযোগ সৃষ্টি করা; আর্থিক ও ব্যাংক খাতে বাজার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে না পারায় সেবার নিম্নমান এবং আমানতে প্রদেয় বনাম বিনিয়োগে ধার্য করা সুদে অস্বাভাবিক ফারাক এবং হিসাবে ছয়-নয়; ব্যক্তি খাতের মালিকানা শতকরা ৯২ ভাগ আমানতকারী হলেও মুষ্টিমেয় মালিকের স্বার্থে এবং জাতির পিতার সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক দর্শনের বিপরীতে বৈষম্য সৃষ্টিকারী একটি ব্যাংকে একটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তাদের মেয়াদ বাড়ানো (এখন অবিশ্বাস্য ১২ বছর); ব্যাংক ঋণখেলাপিদের জামাই আদরে লালন-পালন এবং নিত্যপণ্যের বাজার স্বল্পসংখ্যক অতি মুনাফাপ্রত্যাশীর সিন্ডিকেট বিনা তদারকিতে দেওয়ার ফলে সরকারের হিমালয়সম অর্জন সত্ত্বেও জনদুর্ভোগ বেড়ে চলেছে। আমার দাপট সারা বিশ্বে এখন আয়ত্তের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রে গত এক বছরে আমাকে ৯.১ শতাংশ থেকে ৪.০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। যুক্তরাজ্যে গত ডিসেম্বরে আমি ১০.৫ শতাংশে উল্লম্ফন দিলেও এখন ৬ শতাংশ। ভারতে আমি গত বছর জুনে ৭ শতাংশ ছিলাম; এখন তারা আমাকে ৪.২৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে। অবশ্য অনেক দেশেই আমি বাংলাদেশের চেয়ে বেশিমাত্রায় গর্জন করছি। তবে প্রবৃদ্ধির মডেল বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়নে রূপান্তর করতে হলে অবশ্যই সিদ্ধহস্তে দুর্নীতি ও অপচয় দমন, মুদ্রা পাচার, কর ও ঋণখেলাপ দমনের সঙ্গে আমাকেও দৃঢ়হস্তে লাগাম দিতে হবে। কর্তাদের সিন্ডিকেট ভেঙে দিলে অর্থনীতিতে কেয়ামত এসে যাবে অথবা বাংলাদেশের অর্থনীতি অগভীর বলেই সারা বিশ্বে আমি কমলেও বাংলাদেশে এখনো শতকরা ৯.৭৪ ভাগ এসব কোনো কাজের কথা নয়। সিন্ডিকেট সদস্যদের লাইসেন্স বাতিল করে আমদানিকারকের সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়ানো যেতে পারে। ১৯৯৮-এর মতো সরকারি গুদামে (গুদামক্ষমতা ২.৮ মিলিয়ন টন থেকে ৩.৫ মিলিয়ন টনে বাড়ানো তেমন কঠিন হবে কেন!) চাল, গম, পেঁয়াজ, চিনি, সয়াবিন ইত্যাকার নিত্যপণ্যের বিপুল মজুত করে তা দিয়ে বাজার ভাসিয়ে দিলে সিন্ডিকেট সদস্যরা ও তাদের অবৈধ মজুত বাজারে আনতে বাধ্য হবেন। একাধিক বিনিময় হার অতি অবশ্যই অবিলম্বে পরিত্যাজ্য। আর্থিক ও ব্যাংক খাতে সংস্কার প্রয়োজন। করদাতার সংখ্যা বাড়িয়ে কর রাজস্ব আদায়ে বর্তমানে ৩০ লাখ করদাতাকে আগামী পাঁচ বছরে ১ (এক) কোটিতে রূপান্তর করতে হলে কী কী করতে হবে তাও জানা, শুধু সদাশয় সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। উন্নয়ন সহযোগীদের ‘পরামর্শ বাদ’ দিয়ে সামাজিক সুরক্ষা বলয়তুল্য সেভিংস সার্টিফিকেট আকর্ষণীয় করে তৎমাধ্যমে ‘আমি নিরপেক্ষ’ সম্পদ জনগণ থেকে সরকারে হস্তান্তর করা নানা দিকে কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্য শুভ হবে। অকটেনে ও ডিজেলের দাম না কমিয়ে বিপিসির সাংবৎসরিক লাভের অর্ধেক সরকারি কোষাগারে নিতে হবে। তবে পণ্য পরিবহনে ডিজেল ব্যবহারে ভর্তুকি দিতেই হবে। জাতির পিতার একান্ত চিন্তা প্রতিটি গ্রামে উৎপাদন ও বিপণন সমবায় গঠন করা জরুরি। নতুবা ছোট ছোট কোম্পানি গঠন করে পদ্মা, বঙ্গবন্ধু যমুনা ও অন্যান্য বিপুল সংযুক্তি সৃষ্টিকারী অবকাঠামো মাধ্যমে পণ্য বাজারজাত করা হলে উৎপাদনকারীরা বর্তমানের চেয়ে বেশি মূল্য পাবেন আর বিশেষ করে শহুরে ভোক্তারা দেবেন অনেক দাম। অর্থাৎ আমার দাপট কমবে। অনুরূপভাবে প্রয়োজন হলে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের প্রসার ঘটিয়ে কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্রশিল্পের প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে লালন ও ব্যাংব্যাবল উদ্যোক্তা হিসেবে রূপান্তর করা হলে দারিদ্র্য আরও কমবে, বৈষম্য হ্রাস পাবে এবং আমি চুপসে যাব। তাছাড়া হাতের কাছে থাকা পরীক্ষিত নীতি কৌশলে গুঁড়া দুধ, ফার্নিচার, নির্মাণসামগ্রী, সিএনজি, খেলাধুলার সরঞ্জাম, হাতঘড়ি, গাড়ি নির্মাণ শিল্পে বিনিয়োগ সুবিধা দিলেও সাড়ে চৌদ্দ বছরের দৃষ্টিনন্দন বিশাল অর্জনের সফল সমাপ্তিতে সোনার বাংলার স্বপ্নতীর্থ আরও কাছে আসবে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সমাজচিন্তক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।