গড়ে তুলেছেন এমপি লীগমামলাবাজ এমপি জর্জ ভুয়া ব্যারিস্টার

পারিবারিক রাজনৈতিক অবস্থান এবং ত্যাগকে পুঁজি করে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সেলিম আলতাফ জর্জ। ওই সময় পর্যন্ত কখনো কোনো রাজনৈতিক পদপদবি না থাকলেও বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগেরই সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছেন। গড়ে তুলেছেন এমপি লীগ। কুমারখালী-খোকসা উপজেলায় পরিচিতি পেয়েছেন মামলাবাজ এমপি হিসেবে। নিজের কথার বাইরে গেলে অনুগতদের দিয়ে ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করান। এসব মামলার বিবাদী অধিকাংশই আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। সেলিম আলতাফ নিজেকে সর্বত্র ব্যারিস্টার হিসেবে পরিচয় দিলেও আদতে তিনি তা নন। ইংল্যান্ডের ব্যারিস্টার রেকর্ডে সেলিম আলতাফ নামে কোনো ব্যরিস্টারের রেকর্ড নেই।

কুমারখালী-খোকসা এলাকার আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ দুই উপজেলার ওয়ার্ড পর্যায় থেকে শুরু করে উপজেলার শীর্ষ পদ পর্যন্ত সরকারি দলের নেতাকর্মীরা প্রায় সবাই মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত। কারও বিরুদ্ধে একটি থেকে শুরু করে দশটিরও অধিক মামলা রয়েছে। বিরোধী দলের আমলে বাড়িতে থেকে রাজনীতি করতে পারলেও সরকারি দলের অনেকেই নিজ বাড়িতে থাকতে পারেন না। হারিয়েছেন সম্পদ। কেউ কেউ মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে দুনিয়ার মায়াও ত্যাগ করেছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এসব মামলা এবং নির্যাতনের পেছনে রয়েছে সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফ। এ দুই উপজেলায় ওই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দটি করলেও মামলার ঘানি টানতে হয়। প্রতিবাদ করা যায় না নির্যাতন-দখলের বিরুদ্ধেও। সেলিম আলতাফের বাড়ি কুমারখালী উপজেলায়। গত নির্বাচনে জয়লাভ করার পর থেকে কুমারখালী পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান অরুণকে নিয়ে আলাদা বলয় গড়ে তোলেন। অরুণ সম্পর্কে সেলিম আলতাফের চাচা। আধিপত্য তৈরি করতে বেছে নেন দলীয় নেতাকর্মী নির্যাতনের পথ।

এমপির নির্যাতনের শিকার হওয়াদের একজন আনিসুর রহমান। ওসমানপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং একই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যানও। ছিলেন কৃষক লীগের খোকসা উপজেলা শাখার সাবেক সভাপতিও।

আনিসুর রহমান বলেন, কুমারখালী-খোকসা এলাকায় একটাই দল জর্জ লীগ। এমপি লীগ। এর বাইরে কোনো দল নেই। আমরা নিজেদের অর্থ-শ্রম দিয়ে যে দল তৈরি করেছি, তার কোনো মূল্য নেই। তিনি বলেন, থানার মধ্যে প্রায় তিন ঘণ্টা বসে থেকে এমপি আমাকে গ্রেপ্তার করান। আমার সামনেই পুলিশকে চাপ দেন যেন আমাকে নির্যাতন করা হয়। আমার দুই ছেলের বিরুদ্ধেও মামলা দেওয়া হয়। যদিও তারা এলাকায় থাকে না। একজন ঢাকায় এবং আরেকজন কুষ্টিয়ায় থেকে পড়াশোনা করে। কিন্তু ওদের জীবনকেও অনিশ্চিত করতে মামলার ফাঁদে ফেলা হয়।

খোকসা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শিমুল খান। তিনিও সাতটি মামলার আসামি। এ বিষয়ে শিমুল বলেন, সেলিম আলতাফ মামলাবাজ এমপি। ওয়ার্ড থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মী নানা মামলার আসামি। এমপির কথামতো না চললেই মামলা দিয়ে হয়রানি নিত্যকার ঘটনা কুমারখালী-খোকসায়। দেড় শতাধিক মামলায় বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ইউনিয়ন থেকে শুরু করে কলেজ, পৌরসভা, থানা এবং জেলায় ছাত্রলীগের দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু সাতটি মামলা দেওয়া হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। এমপি ঘনিষ্ঠরা এসব মামলা দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এ দুই উপজেলায় বর্তমানে মামলার সংখ্যা দেড় শতাধিক। শতাধিক মামলার তালিকা রয়েছে কালবেলার হাতেই। এর মধ্যে খোকসায় রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি রহিম উদ্দিন খান, কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আরিফুল আলম তশর, সাধারণ সম্পাদক রহমত আলী জোয়াদ্দার, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফেরদৌস মিয়া, গোপগ্রাম ইউপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আলমগীর হোসেন, দপ্তর সম্পাদক নারায়ণ চক্রবর্তী, শিমুলিয়া ইউপির সভাপতি আব্দুল মান্নান, সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শুটকা, আমবাড়িয়া ইউপির সাধারণ সম্পাদক বাবুল মণ্ডল, সভাপতি মনিরুজ্জামান ইদবারসহ বেশিরভাগ ইউপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা কমিটির বেশিরভাগ নেতাই মামলার আসামি। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পৌরসভার মেয়র তরিকুল ইসলামের বাড়িতে হামলা এবং গুলিবর্ষণের ঘটনাও ঘটে। এ ছাড়া খোকসা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান হবি, আইন সম্পাদক আতিকুল ইসলামসহ অনেক নেতাকর্মীর বাড়িতে হামলা ও গুলির ঘটনা ঘটে।

একই অবস্থা কুমারখালী উপজেলায়ও। দলটির উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত নেতাকর্মীরা মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত। কুমারখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং উপজেলা চেয়ারম্যান মান্নান খান বলেন, আমার পরিবারের ১১ জন সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। আমার ভাই ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে জেল খাটেন। সেখানে নির্মম নির্যাতনের কারণে কিছুদিন পরই মারা যান। সেই ভাইয়ের পরিবারের সদস্যদেরও ছাড় দেওয়া হয়নি। আমার ভাবিকে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। ভাতিজাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে।

তিনি বলেন, আমি ৩০ বছর ধরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক। অথচ আমার পরিবারও রক্ষা পায়নি। জেলা নেতৃবৃন্দ এবং কেন্দ্রীয় দপ্তর সেলে বিষয়গুলো জানিয়েছি। আশা করছি, তারা বিষয়গুলো দেখবেন।এ বিষয়ে পাওয়া তথ্য মিথ্যা হলে সঠিক তথ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, যখন এ কথাগুলো বলেন, এ কথাগুলো বলার পেছনে কী উদ্দেশ্য, কী জন্য করেন তা আমি এবং আমরা ভালোভাবে বুঝি। আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা যেখানে প্রয়োজন, সেখানেই সরবরাহ করা হবে। উদাহরণ টানতে গিয়ে তিনি বলেন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যেমন সনদ নিয়ে পত্রিকার অফিসে অফিসে দিয়ে বেড়ায় না। ব্যারিস্টার পাস করা লোকও তার সনদ নিয়ে অফিসে অফিসে দিয়ে বেড়াবে না। এটি করার জন্য তার যেখানে যেখানে সংশ্লিষ্ট জায়গা সেখানে সে দেবে। পত্রিকার অফিসে অফিসে দিয়ে বেড়ানো এটি কোনো কাজ না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।