নির্দলীয় সরকার মূল দাবিএকদফায় অনড় বিএনপি, আ.লীগের অধীনে যাবে না

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একদফা দাবিতে অনড় দলটি। কোনো রকম আপস না করে রাজপথে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিষয়টি ফয়সালা করার লক্ষ্য তাদের। যদিও রাজনৈতিক কর্মসূচির পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতারও কমতি নেই বিএনপির।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কখনোই সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় না। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নজিরবিহীন ভোট জালিয়াতির পর বর্তমান সরকার ও ইসির অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়া যায় না। কারণ সব নির্বাচনের ফলাফলই পূর্বনির্ধারিত এবং ইসির ভূমিকাও একই থাকে। তাই শুধু শুধু নির্বাচনে গিয়ে এই সরকার ও ইসিকে বৈধতা দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না। এমন মনোভাব স্পষ্ট করেই সমমনা বিভিন্ন দল ও জোটকে একই প্ল্যাটফর্মে আনতে সক্ষম হয়েছে বিএনপি।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, ক্ষমতাসীনরা এবারও যে কোনো উপায়ে বর্তমান সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চায়। বিএনপির কাছে বিষয়টি স্পষ্ট। কিন্তু এ অবস্থায় দাবি আদায়ে রাজপথেই সমাধান খুঁজছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বিনা ভোটে একতরফা ও বিতর্কিত নির্বাচন করেছে। কিন্তু এবার তাদের সে ধরনের সুযোগ দেওয়া হবে না।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালবেলাকে বলেন, ‘নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। এটা নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই। কারণ বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাটা আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে বিনষ্ট হয়ে গেছে। নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার না থাকলে নির্বাচন কমিশন কিছুই করতে পারে না। সে কারণেই আমরা বিগত নির্বাচনগুলো বর্জন করেছি। নতুন ইসি গঠনের আগে সার্চ কমিটিতেও অভিমত দিয়েছি। কিন্তু এই সরকার কোনোকিছু গ্রহণ করেনি। এই পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না।’ তিনি বলেন, ‘প্রায় অর্ধশত রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলন করছে। এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সেজন্য সরকারকে দ্রুত পদত্যাগ ও সংসদ বিলুপ্ত করে নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন হতে হবে। সেখানে জনগণ যাকে খুশি ভোট দেবে।’

এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু সেই নির্বাচন ঠেকানো সম্ভব হয়নি। ফলে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। ওই সময় রাজনৈতিক সংকট নিরসন ও নির্বাচন নিয়ে মধ্যস্থতা করতে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় এসেছিলেন। তার উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বৈঠকও হয়।

বিএনপি নেতাদের দাবি, তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচনের অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছিল। এরপর স্বল্পতম সময়ের মধ্যে আরেকটি নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছিলেন তারা। পরে সরকার সেই ওয়াদা রক্ষা করেনি। উল্টো বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রা বেড়েছে।

অবশ্য দলীয় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। ওই নির্বাচনের আগে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশায় প্রধানমন্ত্রীর ডাকা সংলাপেও গিয়েছিলেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নিয়ে কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি বিএনপি। ওই নির্বাচনে দলটি মাত্র সাতটি আসনে বিজয়ী হয়। নির্বাচনের পর বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে সংলাপে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেননি প্রধানমন্ত্রী। অতীতের এসব অভিজ্ঞতা থেকে এবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় বিএনপির হাইকমান্ড।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য কালবেলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবেন না। কারণ আগের নির্বাচনগুলোতে সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগমুহূর্তে মিথ্যা মামলা দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। ভোটের মাঠে বিএনপি প্রার্থীদের প্রচারে হামলা ও বাধা দেওয়া হয়। সর্বশেষ নির্বাচনের আগের রাতে তারা কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করে রাখে। এ ধরনের অভিজ্ঞতার পরও তাদের অধীনে সুষ্ঠু ভোট আশা করা যায় না।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আগামী নির্বাচনে এই রেজিমের (আওয়ামী লীগ) অধীনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না। কারণ তাদের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। আমরা বিগত দিনে আলোচনাও করেছি, নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেছি। তার ফল দেশের মানুষ পেয়েছে। বিশ্ববাসীর কাছেও এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট—একমাত্র নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। কারণ এরা (সরকার) এখনই নির্বাচনের চুরি শুরু করে দিয়েছে। ডিসিদের বদলি করেছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের পোস্টিং দিচ্ছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। হাত কেটে দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে একদফার আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের জন্য নিজেদের প্রস্তুতি করছে বিএনপি। এ জন্য দল সমর্থিত পেশাজীবী সংগঠনের মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থীদের খোঁজে জরিপ কাজ শুরুর প্রক্রিয়া চলমান। আসনভিত্তিক নির্দিষ্ট ফরমে এই জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ব্যক্তিগত তথ্যের পাশাপাশি সাংগঠনিক পরিচিতি, মামলা-হামলার বিবরণ, আগের নির্বাচনে তার অবস্থান, নির্বাচনী ফলাফল, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে বিদ্রোহ কিংবা সিদ্ধান্ত অমান্য করার ইতিহাস, ব্যাংক ঋণ, শিক্ষাগত যোগত্যা, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক, তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা, ক্ষমতাসীন দলের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। তবে এ ধরনের জরিপের বিষয়ে দায়িত্বশীল কোনো নেতা মন্তব্য করেননি।

এদিকে দলীয়ভাবে বয়কট করা হলেও বিএনপির একটি অংশ আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যেতে পারে—রাজনীতিতে এ ধরনের গুঞ্জন রয়েছে। তবে এ বিষয়ে বিএনপি খুব বেশি শঙ্কিত নয় বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘সরকার তার জায়গা থেকে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু এত হামলা-মামলা, নির্যাতন-নিপীড়নের পরও আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে সম্ভব? দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত, বিএনপি নির্বাচনে যাবে না এবং এটাই চূড়ান্ত। সমঝোতার কোনো অবকাশ নেই।’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।